প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করে বসতবাড়িতে সমন্বিত খামার
মৃত্যুঞ্জয় রায়
করোনাভাইরাস আমাদের নতুন করে অনেক কিছুই শিখিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, করোনা যদি থেকেই যায় তো তার সাথে তো আমাদেরও থাকতে হবে। সারাক্ষণ এ রকম আতংক নিয়ে কি বাঁচা যায়? কিন্তু এটাও সত্যি, এ রকম ভয় যার মনে বাসা বাঁধবে করোনা তাকে মারার আগে সেই ভয়ই তাকে আগে মারবে। ভয় না করে করোনাকে জয় করতে হবে। এজন্য প্রত্যেকেরই এখন
দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাটা যে কোনভাবেই হোক ঠিক রাখতে হবে, সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। রোজ একটা লেবু, একটা ডিম, একটু শাকসবজি, দুধ, মাংস বা মাছ-এগুলো খেতে হবে। কোনভাবেই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এখন কমতে দেয়া যাবে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শুধু করোনা না, অন্য রোগও দ্রæত আমাদের কাবু করে এমনকি মেরে ফেলতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে দরকার রোজ পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাবার। বসতবাড়ির আঙ্গিনাটাই হতে পারে সেসব নিরাপদ পুষ্টিকর খাবারের প্রধান উৎস। বসতবাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গা সদ্ব্যবহার করে আমরা উৎপাদন করতে পারি টাটকা শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, মাংস, দুধ, মাছ, মসলা ইত্যাদি। এতে শুধু পরিবারের পুষ্টি বা স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নয়-পরিকল্পিতভাবে প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করলে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বাড়তি আয় করাও সম্ভব।
সমন্বিত খামারের ধারণা
যেখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় সেটাই হলো খামার। বসতবাড়িতে বহু রকমের পণ্য উৎপাদিত হয় বলে তা বহুমুখি খামার। এরূপ খামারে বিভিন্ন উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ককে বিবেচনা করে অর্থাৎ একটির উপজাত আর একটির উৎপাদনে ব্যবহার করে যখন পরিকল্পিতভাবে উৎপাদন করা হয় তখন তা সমন্বিত খামারে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটে। এরূপ খামারে উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় করা যেমন সম্ভব হয় তেমনি বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের সুযোগ ঘটে। এতে ব্যবসায়িক ঝুঁকিও কমে।
প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহারের পরিকল্পনা
বসতবাড়িকে একটি স্বপ্নের সুন্দর বাড়ি বানাতে হলে তার জন্য প্রথমেই দরকার একটি সঠিক পরিকল্পনা। আপনার বাড়ি যেমনই হোক, যতটুকু জায়গাই থাকুক- তাকে একটি সুন্দর রূপ দেয়া কিন্তু সম্ভব। এজন্য প্রথমে আপনাকে কাগজে একটা নকশা এঁকে নিতে হবে। বাড়ির জমি যতটুকু আছে সে অনুযায়ী কাগজে দিকনির্দেশ করে প্রথমে বাড়ির সীমানা বা চৌহদ্দি আঁকতে হবে। এরপর বাড়িতে প্রবেশ পথ চিহ্নিত করতে হবে। সীমানার ভেতরে যেখানে যে স্থাপনা মানে ঘরবাড়ি, পুকুর, শৌচাগার, গোয়াল, হাঁস-মুরগির ঘর, টিউবওয়েল ইত্যাদি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর নকশায় দেখাতে হবে কোথায় কি গাছপালা আছে। বর্তমানে যেখানে যা আছে তা আঁকার পর এবার দেখতে হবে কোথায় কোন জায়গা কতটুকু কি উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ আছে। একটি বাড়িতে নানা ধরনের জায়গা থাকে। সব জায়গাকেই উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, প্রতি ইঞ্চি জায়গার সদ্ব্যবহার করতে হবে, রাখতে হবে উঠোন। উৎপাদন পরিকল্পনায় ভারসাম্য রাখতে হবে যাতে সারা বছর বসতবাড়ি থেকে প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ খাবারের যোগান নিশ্চিত করা যায়।
শুরুর কাজ
পরিকল্পনা সঠিকভাবে করলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। বসতবাড়িকে স্বপ্নের বাড়ি বানাতে হলে পরিবারের সকলকেই প্রথমে একটু সময় দিতে হবে। পরিবারের সদস্যরা মিলে একসাথে কাজ করলে কাজটা করা সহজ হবে, নিজেরা কিছু দৈহিক পরিশ্রম করে শরীরটাকে ঠিক রাখা যাবে আর পারিবারিক সম্পর্কেরও উন্নতি হবে। নিজেদের পরিশ্রমে গড়া পারিবারিক খামার থেকে উৎপাদিত খাদ্য আপনাদের দেবে পুষ্টি, সুস্বাদ ও অনাবিল আনন্দ। তাই বসতবাড়িতে আপনি কি করতে চাইছেন তা পরিবারের সদস্যদের
সাথে আলোচনা করুন। সদস্যদের পছন্দকে গুরুত্ব দিন। এরপর কোথায় কি উৎপাদন করবেন তার একটা তালিকা তৈরি করুন। উৎপাদনে যাওয়ার আগে দুটো কাজ আপনাকে করতে হবে- প্রথমে বাড়ির সীমানায় প্রাচীর থাকলে ভালো, না হলে বেড়া দিয়ে বাড়িটাকে ঘিরে ফেলুন। সুরক্ষা ও সৌন্দর্যের জন্য এটা দরকার। যে কেউ দেখে যেন বুঝতে পারেন যে ওই ঘেরা জায়গাটুকুই আপনার বাড়ি। দ্বিতীয় কাজটা হলো, আপনার ঘরবাড়ি, গোয়াল বা হাঁস-মুরগির ঘর এসব যতটা সংস্কার করে আধুনিক করা সম্ভব তা করে ফেলুন। একবারে না পারলে ধাপে ধাপে করা যায়। পুকুর থাকলে তা সংস্কার করুন। এসব স্থাপনা আধুনিকায়ন করতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
বসতবাড়ির যে জায়গায় যা করা যায়
বসতবাড়িতে নানা ধরনের জায়গা থাকে। কোনো জায়গায় রোদ পড়ে- কোনো জায়গায় থাকে ছায়া। কোনো জায়গা উঁচু, কোন জায়গায় ডোবা। যে কোনো জায়গায় যে কোন কিছু উৎপাদন করা যায়না। এজন্য স্থান উপযোগী পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান ঠিক করতে হবে। আপনার বসতবাড়িতে যে ধরনের জায়গা রয়েছে সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন বা ফসল চাষের জন্য বেছে নিতে পারেন। সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
যেভাবে করবেন
শাকসবজি চাষ : খোলা স্থানে কালিকাপুর মডেলে ৬ মিটার লম্বা ও ৬ মিটার চওড়া জায়গা ঘিরে পাঁচটি বেডের একটি সবজি বাগান করবেন। শীতকালে সেখানে চাষ করবেন পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, পিয়াজ, বাটিশাক, লালশাক, মুলা, ঝাড়শিম, টমেটো ইত্যাদি। গরমকালে ও বর্ষাকালে চাষ করবেন গিমাকলমি, পুঁইশাক, ঢেঁড়স, লালশাক, ডাঁটা, মুখিকচু, ওলকচুু ইত্যাদি। সবজি ক্ষেতের চারপাশের বেড়ার কোলে লাগাতে পারেন মরিচ, বেড়ার উপরে বরবটি ও করলা। শাকসবজির উন্নত জাতের বীজ বা চারা ব্যবহার করবেন, কেঁচোসার দেবেন, ঠিকমতো সেচ দেবেন, বালাই আক্রান্ত গাছের অংশ তুলে ফেলবেন ও আগাছা পরিষ্কার করবেন, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ দেবেন, কোন বালাইনাশক ব্যবহার করবেন না।
ফল চাষ : প্রতি মাসেই যেন বাড়ির আঙ্গিনায় ফল পেতে পারেন এজন্য কমপক্ষে বারো রকমের ফলগাছ লাগাবেন। বারোমাস পাওয়া যায় পেঁপে ও কলা। শীতে পাবেন মালটা, কুল ও কমলা, গ্রীষ্মে পাবেন আম, লিচু, শরিফা, কাঁঠাল, জামরুল, গ্রীষ্ম-বর্ষায় পেয়ারা। শরতে ডালিম, মালটা, বাতাবি লেবু, আমড়া, কদবেল। হেমন্তে কামরাঙ্গা, বসন্তকালে বেল। উন্নত জাতের চারা-কলম লাগিয়ে যতœ নেবেন। আম, পেয়ারা, কলা, ডালিম ইত্যাদি ফলে ব্যাগিং করতে হবে। ফলগাছে পরিমাণ মতো কেঁচোসার ব্যবহার করবেন, পারতপক্ষে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করবেন না।
ঔষধি গাছ : বসতবাড়ির আঙ্গিনায় কিছু ঔষধি গাছ যেমন থানকুনি, বাসক, তুলসী, পুদিনা, কালমেঘ, পাথরকুচি, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি গাছ লাগাতে পারেন। হাতের কাছে থাকা এসব গাছ আপনাকে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারবে।
ফুল চাষ : বাড়ির শোভা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু ফুল ও বাহারি গাছ লাগানো যায়। জায়গা বেশি থাকলে ব্যবসায়িকভাবে গø্যাডিওলাস, গোলাপ, রজনীগন্ধা, জিপসোফিলা, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, গাঁদা ইত্যাদি ফুলের চাষ করে আয় করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তিতে এসব ফুলের চাষ করতে হবে। ছাউনিঘর করে তার ভেতরে গø্যাডিওলাস, লিলিয়াম ও জারবেরা ফুলের চাষ করা যায়।
ছাগল ও ভেড়া পালন : ছাগলের জন্য মাচাযুক্ত ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে, লতাপাতা ও ঘাসের পাশাপাশি রোজ দানাদার খাবার খাওয়াতে হবে, নিয়মিত ছাগলকে টিকা দেবেন ও কৃমিনাশক খাওয়াবেন।
গরুপালন : দুধ ও মাংসের জন্য গরু পালন করতে পারেন। গোয়ালঘরকে আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত ঘরে রূপান্তরিত করবেন। গরুকে কৃমিনাশক খাওয়াবেন ও টিকা দেবেন। ঘাসপাতার ও খড়ের পাশাপাশি গরুকে রোজ পরিমাণ মতো দানাদার খাবার খওয়াবেন। গরু মোটাতাজা করতে হলে সেসব গরুকে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস খাওয়াবেন। এটা সহজে খড়, চিটাগুড় ও ইউরিয়া সার মিশিয়ে বাড়িতে বানিয়ে নেয়া যায়। ইউএমএস খাওয়ালে গরুর ওজন ও মাংস দ্রæত বাড়ে।
হাঁস-মুরগি পালন : যদি পুরনো ঘর থাকে তবে তাকে আধুনিক ঘরে রূপান্তরিত করুন। মুরগির ঘরকে তিনতলা করবেন, হাঁস-মুরগিকে উন্নত খাবার রোজ পরিমাণ মতো খেতে দেবেন ও নিয়মিত টিকা দেবেন। মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য উন্নত হাজল ব্যবহার করবেন।
পুকুরে মাছ চাষ : পুকুর পাড়ের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করবেন। চৈত্র মাসে পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে পুকুর সংস্কার করে চুন প্রয়োগ করা যায়। পুকুরের পানির গভীরতা বুঝে মাছের প্রজাতি নির্বাচন করে সঠিক পরিমাণে পোনা ছাড়বেন। পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, পাঙ্গাস, নাইলোটিকা ইত্যাদি মাছ চাষ করা যায়। গড়ে প্রতি শতক জলায়তনের পুকুরে মিশ্র মাছ চাষের জন্য প্রায় ২৫-৩০ টি পোনা ছাড়া ভাল। চৈত্র-বৈশাখ মাস পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। মাছকে নিয়মিত খাবার খেতে দিতে হবে।
“প্রতি ইঞ্চি জায়গার সদ্ব্যবহার
বসতবাড়ি হবে সমন্বিত খামার।” য়
প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট- ২য় পর্যায় (আইএফএমসি- ২) প্রকল্প, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা, মোবাইল : ০১৭১৮২০৯১০৭, ই-মেইল : kbdmrityur@yahoo.com